* মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে বসানো হয়েছে বজ্র নিরোধক যন্ত্র
* প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বজ্র নিরোধক যন্ত্র স্থাপনের দাবী চরবাসীর
রাশেদ, বিশেষ প্রতিনিধি (বগুড়া): বর্তমান সময়ে বজ্রপাত একটি আতঙ্ক। দেশে প্রতি বছরই বজ্রপাতে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছেন বহু মানুষ। এর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলের খোলামাঠে।
সরকারি হিসেবে গত চার বছরে বগুড়ায় বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ৪০ জন মানুষের। যার অধিকাংশই চরাঞ্চলের কৃষক এবং শ্রমিক। তাছাড়া এ ঘটনায় আহত হয়ে চিরজীবনের মত কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন অনেকে। বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় ২০১৫ সালে সরকার একে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দেয়।
গত ১৭ অক্টোবর উপজেলার কর্ণিবাড়ী ইউনিয়নের ডাকাতমারা চরে মরিচের জমি নিড়ানি দেয়ার সময় বজ্রপাতে নিহত হন রংপুর কাউনিয়া উপজেলার বালা পাড়া ইউনিয়নের আরাজিহরিশ্বর গ্রামের সোলাইমান মন্ডলের ছেলে আব্দুর রশিদ মন্ডল (৪০)। তিনি নিজের এবং পরিবারের পেটের ভাত জোগাড় করতে দিনমজুরের কাজ করতে এসেছিলেন বগুড়া সারিয়াকান্দিতে। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মারা যাওয়ার ঘটনায় তার পরিবার এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ ঘটনায় একই গ্রামের আপান উল্লাহ মোল্লার ছেলে আশরাফুল ইসলাম (৪৫) এবং সাহার উদ্দিনের ছেলে বাবু মিয়া (৫১) আহত হয়েছেন। এটি এ উপজেলার বজ্রপাতে নিহত হওয়ার সর্বশেষ ঘটনা। চর এলাকায় কোনও উঁচু গাছপালা এবং ঘরবাড়ি না থাকায় চরের কৃষক এবং শ্রমিকরা এ ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। আর এ দুর্ঘটনার শিকারে পরিবার হচ্ছে দিশেহারা। তাই চরাঞ্চলে বজ্রপাত নিরোধক দন্ড স্থাপনের দাবি এলাকাবাসীর।
বজ্রপাত থেকে নিজেদের প্রাণ রক্ষার্থে উপজেলার যমুনার প্রতিটি চরে বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র চান চরবাসী। তবে বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনে ঝুঁকিপূণ অন্যতম বজ্রপাতপ্রবণ জেলা বগুড়াতে পরীক্ষামূলকভাবে দুইটি বজ্র নিরোধক দন্ড বা লাইটেনিং অ্যারেস্টার বসিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান পল্লী উন্নয়ন একাডেমি।
গবেষণা বলছে, সেই দুই বজ্রনিরোধকের দেড় কিলোমিটার সীমানায় গত এক বছরে কোন ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
বগুড়ায় যমুনার করাল গ্রাসে প্রতি বছরই সর্বস্বান্ত হয়ে এক চর থেকে অন্য চরে আশ্রয় নিতে হয় চরবাসীর। নদীর সঙ্গে লড়াই করে চলে মানুষের জীবন-জীবিকা। চরের সিংহভাগ মানুষই নিম্নবিত্ত, যারা কৃষিতেই নির্ভরশীল। চরে চাষ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের দেশি-বিদেশি সবজি ও উচ্চফলনশীল মরিচসহ নানা জাতের ফসল। এখানে উৎপাদিত নানা ফসল রপ্তানি হচ্ছে সারা দেশে। কিন্তু ঘরবাড়ী এবং বৃক্ষহীন বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তরে কাজ করতে গিয়ে প্রাণঘাতী বজ্রপাতে প্রায়ই মৃত্যুর শিকার হতে হয় কৃষক, শ্রমিকসহ সাধারণ জনতার। এ ঘটনায় মৃত্যু রোধে একাধিক প্রকল্পও নেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি হলো ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বজ্র নিরোধক যন্ত্র বসানো। এরই অংশ হিসেবে সারিয়াকান্দির নয়াপাড়া চরে গতবছর একটি বজ্র নিরোধক দন্ড বসিয়েছে বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি। আরেকটি বসানো হয়েছে তাদের নিজস্ব ক্যাম্পাসে। বজ্রনিরোধক দন্ড উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎকে নিরাপদে মাটির গভীরে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেয়। ৩০-৪০ ফুট লম্বা দন্ডে তিন-চার ইঞ্চি জিআইপি পাইপ এবং তামার তার থাকে। দন্ডের ওপরে একটি ডিভাইস বসানো থাকে। যাকে লাইটেনিং অ্যারেস্টার বলে। এর মূল কাজ নির্ধারিত ব্যাসের মধ্যে বজ্রপাত হলে তা টেনে মাটিতে সরবরাহ করা। সারাক্ষণ সক্রিয় থাকে এই যন্ত্র। এতে করে মাঠে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারেন চাষীরা।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় যমুনার মোট ৭১টি চরে প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। এসব চরের মাঠে মাঠে আরো বজ্রনিরোধক দন্ড বসানোর দাবী জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
দুর্ঘটনার শিকার ডাকাতমারা চরের আয়েন উদ্দিন বলেন, আমাদের চরাঞ্চলে বজ্রপাতে প্রতি বছরই বহু মানুষ এবং প্রাণী হতাহতের শিকার হচ্ছে, তাছাড়া ফসলেরও ক্ষতি হচ্ছে । তবে হাটশেরপুর ইউনিয়নের নয়া পাড়া গ্রামে বজ্রপাত নিরোধক দন্ড স্থাপনের জন্য সেখানে এ ধরনর কোনও ঘটনার সৃষ্টি হয়নি। তাই আমাদের চরবাসীর দাবি নয়া পাড়ার মতো আমাদের প্রতিটি চরে বজ্রপাত নিরোধক দন্ড বসানো হোক।
বগুড়া জেলা পল্লী উন্নয়ন একাডেমির চর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ড. মো. আব্দুল মজিদ আমাদের সময়কে বলেন, বজ্রপাতে দেশের চরাঞ্চল এবং হাওর অঞ্চলে কৃষক শ্রমিকের মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেড়ে গেলেও আমাদের স্থাপিত লাইটেনিং অ্যারেস্টারের ব্যাসের মধ্যে কোন ক্ষয়ক্ষতি হয় নি। তাই বজ্রাঘাতে কৃষক শ্রমিকের প্রাণহানি ঠেকাতে চরাঞ্চলে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পর্যাপ্ত পরিমাণে বজ্রপাত নিরোধক দন্ড স্থাপন করা প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে পল্লী উন্নয়ন একাডেমি কাজ করছে বলেও নিশ্চিত করেন এই কর্মকর্তা।